এ এক আবিষ্কারের গল্প: ক্যাম্প মাটি-টা
২৯জানুয়ারী,বুধবার,মো.ইরফান চৌধুরী চট্টগ্রাম,নিউজ একাত্তর ডট কম: অসীম সম্ভাবনা আর প্রতিভা নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে আসে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বিকশিত হয় প্রতিভা। তবে মানবসৃষ্ট কারণে এই পরিবেশ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে পৃথিবী। এ নিয়ে আমাদের কার্যক্রম অনেকটাই ভাবনা-চিন্তা আর মতামত আদান-প্রদানের মাঝে সীমাবদ্ধ।
এদিকে, অপার সম্ভাবনা থাকার পরও বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে। আছে প্রতিকূলতা, নানা জটিলতা। পরিকল্পনা আর দূরদর্শিতার অভাব আছে। আছে সমন্বয়হীনতা।
এর মাঝেও অন্তরায়ের দেয়াল ভাঙার স্বপ্ন দেখে কেউ কেউ। তাদের স্বপ্ন থাকে আকাশচুম্বী। তেমনই স্বপ্নের কারিগর চট্টগ্রামের তরুণ দম্পতি তাসনিম মাহমুদ ও ডা. মুনাল মাহবুব। তারা চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান ও নৌবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা (অব.) জহিরউদ্দিন মাহমুদ এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলমের সন্তান। শিক্ষা শেষ হয়েছে অনেক বছর আগে। দুজন বর্তমানে উদ্যোক্তা।
ডা. মুনাল মাহবুব চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। সময় পেলে পৃথিবী ঘুরে দেখা তাদের সখ। সেই সখ মেটাতে গিয়ে সঞ্চয় করেছেন অভিজ্ঞতা। একদিন তাদের উপলব্ধি হলো, প্রকৃতি প্রদত্ত সম্ভাবনা ও সক্ষমতা এবং বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশকে কীভাবে একসূত্রে গাঁথা যায়? কথাটা বলছিলেন ক্যাম্প মাটি-টার চেয়ারম্যান ডা. মুনাল মাহবুব।
ক্যাম্পের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাসনিম মাহমুদ জানান, পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের সাথে আউটডোর অ্যাক্টিভিটি ক্যাম্পিংয়ের যোগসূত্র স্থাপন তাদের এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। তিনি আরো জানান, বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন তাদের উদ্বেগের কারণ। পরিবর্তনজনিত এই বিপর্যয় মোকাবিলার মানসিকতা এবং তাদের আহরিত অভিজ্ঞতার যোগফল হিসেবে চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম আউটডোর অ্যাক্টিভিটি ক্যাম্প মাটি-টা। এখানকার পারিপার্শ্বিকতা ও সমস্ত আয়োজন একজন শিক্ষার্থী অথবা যেকোনো শ্রেণী-পেশার মানুষকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম, আমিও পারি। রিডিসকভার ইয়োরসেলফ উইদিন ইউ মাটি-টার ট্যাগলাইন। অর্থাৎ ক্যাম্প মাটি-টা কারো মধ্যে নতুন করে কোনা শক্তি বা ক্ষমতা প্রয়োগের কথা বলে না। বরং বিশ্বাস করতে শেখায়, আমার মধ্যে যা আছে তা দিয়েই নিজেকে আবিষ্কার করব। প্রমাণ করে দেখায়, একজন মানুষের মাঝে অসাধারণ সক্ষমতা থাকে।
ক্যাম্প মাটি-টার অবস্থান সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায়। ক্যাম্পের আয়তন প্রায় পৌনে দুই বর্গকিলোমিটার। পাহাড় বেষ্টিত ক্যাম্পের উত্তর সীমানা জুড়ে নৌবাহিনীর দপ্তর, পূর্বে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। পাহাড়ের চূড়া ধরে রয়েছে দীর্ঘ ট্রেকিং ট্রেইল। ট্রেইলের একাধিক পয়েন্ট থেকে উপভোগ করা যায় বঙ্গোপসাগরের অসাধারণ সৌন্দর্য। সাগরে ভাসমান বড় জাহাজের মাস্তুল পাশে রেখে অস্তায়মান সূর্য, দুরন্ত কাঠবিড়ালির লাফিয়ে বেড়ানো, সকাল সকাল বন মোরগের কুক কুরুক ধ্বনিতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, শত প্রজাতির রঙিন পাখির কিচিরমিচির, মাঝেমধ্যে পাহাড় থেকে মায়া হরিণের আগমন অন্য এক মায়া জাগায়। পাহাড় বেষ্টিত ক্যাম্পের প্রাঙ্গণ জুড়ে রয়েছে স্বচ্ছ জলের সরোবর। মাছ ও মাছরাঙ্গা, ধবধবে সাদা বকের লুকোচুরি এখানকার চিত্র।
তাসনিম মাহমুদ জানান, বর্তমানে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলার মাঠ অপর্যাপ্ত। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুুলা জরুরি। পরিবর্তিত আর্থসামাজিক বিশ্ব বাস্তবতায় বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহে কর্মীদের মধ্যে টিম বিল্ডিং ও মানোন্নয়নমূলক কার্যক্রমে এসেছে বৈচিত্র্য। দেশের ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য ডিউক অব এডিনবার্গ অ্যাওয়ার্ড ও ক্যাস নামক আউটডোর কোর্স বা অভিজ্ঞতা প্রায় বাধ্যতামূলক। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে মাটি-টাতে বেশ কিছু অ্যাক্টিভিটির ব্যবস্থা আছে। খেলার গ্রাউন্ড আছে তিনটি। এর মধ্যে একটি হিলটপ গ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত।
তিনি জানান, বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্টিভিটির মধ্যে পাহাড় ট্রেকিং, মেডিটেশন সেশন, ইয়োগা সেশন, স্ক্রু ড্রাইভিং, ওয়াটারপং, ওয়াল ক্লাইম্বিং, rapling-জুমারিং, জিপলাইনিং, লিকুইড পাস, হিউম্যান পাস কায়াকিং, অন ট্রি অবস্ট্যাকল কোর্স, অন গ্রাউন্ড অবস্ট্যাকল কোর্স, বেল্ট রেস, ব্যাডমিন্টন, জায়ান্ট ভলিবল, টেবিল টেনিস, হিউম্যান ফুসবলসহ প্রায় পঞ্চাশটি অ্যাক্টিভিটি অন্যতম। বিশেষ অ্যাক্টিভিটি হিসেবে রয়েছে ডে লং ট্রেজার হান্ট।
তিনি আরো জানান, মেডিটেশন ও ইয়োগা সেশন অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাহাড়ের চূড়ায়। চূড়ার সম্মুখভাগে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি। বয়ে যায় সাগরের শীতল বাতাস। বিশেষ এই জোনে যখন মেডিটেশন ও ইয়োগা অনুষ্ঠিত হয়, তখন ক্যাম্পারগণ সতেজ বাতাসের পরশ অনুভব করেন।
তাসনিম জানান, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিষয়টি মাথায় রেখে ক্যাম্প মাটি-টা পরিচালনা করছে পাঁচদিনের রেসিডেন্সিয়াল প্রোগ্রাম। রেসিডেন্সিয়াল প্রোগ্রামের সৃজনশীল কারিকুলাম তাদের স্বতন্ত্র উদ্ভাবন। এছাড়া রয়েছে রিইউনিয়ন ও বার্ষিক পিকনিক প্রোগ্রামের ব্যবস্থা। অ্যাক্টিভিটিসমূহ পরিচালনার জন্য রয়েছে অভিজ্ঞ ইনস্ট্রাক্টর।
ক্যাম্পের মহাব্যবস্থাপক তারেক আহম্মেদ সুমন জানান, রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রে ক্যাম্পে আগতদের থাকতে হয় তাঁবুতে। এসব তাঁবু দুই থেকে বিশজন ধারণ ক্ষমতার। সম্প্রতি তাঁবুর বহরে যুক্ত হয়েছে আমেরিকা মহাদেশে বসবাসরত রেড ইন্ডিয়ানদের ঐতিহ্যবাহী টিপি টেন্ট (তাঁবু)। প্রতিটি টিপি টেন্টে ষোলজন ক্যাম্পার অবস্থান করতে পারেন। এছাড়া রয়েছে কাঠের তৈরি ইকো টেন্ট। সুবৃহৎ ইনফিনিটি সুইমিং পুলের প্রান্ত ঘেঁষে নির্মাণাধীন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের নির্মাণ শৈলীর আদলে আঠারো হাজার বর্গফুটের বেম্বো হাউজ। মজবুত কাঠামোর উপর তিনতলা বিশিষ্ট বেম্বো হাউজের ভেতর ও বাইরে সম্পূর্ণটা মোড়ানো থাকবে বাঁশ দিয়ে। নিচতলায় একটি কনভেনশন হল, দ্বিতীয়তলা জুড়ে অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্ট ও কনফারেন্স রুম এবং তিনতলায় থাকবে চৌদ্দটি কটেজ কক্ষ। আগতদের রুচি ও বিনোদনের দিক মাথায় রেখে অর্গানিক খাবারের মেনুতে আছে ঐতিহ্যবাহী আইটেমসহ বিভিন্ন স্বাদের খাবার।
গত বছরের ৬ জানুয়ারি ছিল ক্যাম্প মাটি-টার উদ্বোধনী প্রোগ্রাম। এক বছরের মধ্যে এখানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরোট হাউজ তথা সামাজিক প্রতিষ্ঠান প্রোগ্রাম করেছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুল চট্টগ্রাম ও ঢাকা শাখা, আল হিদায়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সাইডার স্কুল, উইলিয়াম কেরি স্কুল, দা আগা খান স্কুল ঢাকা, সিটি ব্যাংক, ডেক্যাথলন, মাইডাস সেফটি, হক অ্যান্ড সন্স শিপিং কোং, বিএসআরএম, চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, সেন্ট প্লাসিডস স্কুল ৯৪ ব্যাচ, মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম রোটারী ক্লাব (অ্যারিস্টোক্রেট) উল্লেখযোগ্য।- আজাদী